NFT বা Non-fungible token একটি ভয়ানক জিনিস। প্রথমেই আমি একটি আশ্চর্যজনক কথা বলে ফেললাম। কিন্তু, এটি বলার পিছনে কারণও আছে। NFT আসলে একটি ভয়ানক জিনিস, কেননা এটি পুরো তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়াকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে এমনকি পরিবর্তন করছে।
এই NFT বা Non-fungible token হচ্ছে একটি ডিজিটাল সম্পদ। এটি বিটকয়েনের মতই একটি Crypto token এবং এই NFT এর একটি মজার বিষয় হচ্ছে যে, আপনি আপনার যেকোন মূল্যবান জিনিস এর মাধ্যমে সংগ্রহ করে রাখতে পারবেন। সবকিছু মনে হয় আপনার মাথার ওপর দিয়ে গেল। চলুন এই NFT সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
NFT বা Non Fungible Token কি?
NFT কি সেটা জানার আগে Non-fungible token মানে কি সেটা জেনে নেয়া যাক। তার জন্য চলুন প্রথমে এই শব্দটির পোস্টমর্টেম করি।
মনে করুন আপনি রিকশায় উঠলেন মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১১ তে যাওয়ার জন্য এবং রিকশা ভাড়া হচ্ছে ৩০ টাকা। রিক্সা থেকে নেমে আপনি রিকশাওয়ালাকে দিলেন ৫০ টাকা। এখন রিকশাওয়ালা আপনাকে ২০ টাকা ফেরত দিবে। রিকশাওয়ালা চাইলে আপনাকে ১০ টাকার দু’টি নোট দিতে পারে আবার ২০ টাকা একটি নোট দিতে পারে। কিন্তু, ১০ টাকার দু’টি নোট দিল নাকি ২০ টাকার একটি নোট দিল সেটা কিন্তু বড় ব্যাপার না। কারণ উভয় ক্ষেত্রে টাকার মান একই। আর একেই বলে fungibility আর যেই জিনিসগুলো এই fungibility এর নিয়ম মেনে চলে তাদের বলা হয় fungible।
কিন্তু, ধরুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি বই। একটি হচ্ছে “চোখের বালি” আর আরেকটি হচ্ছে “শেষের কবিতা”। দু’টি বইয়ের লেখকই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু বই দু’টি ভিন্ন ধর্মী। বই দু’টির মূল ভাব, চরিত্র, ঘটনা সবকিছুই ভিন্ন। অর্থাৎ বই দু’টি Non-fungible এবং তেমনি ভাবে যেই token গুলো এমন ভিন্ন ধর্মী তাদেরকেই বলা হয়ে থাকে Non-fungible token বা সংক্ষেপে NFT।
চলুন আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আশা করি এই উদাহরণটির মাধ্যমে NFT সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পেয়ে যাবেন। মনে করুন আপনি আপনার বন্ধু থেকে একটি অতি মূল্যবান জিনিস কিনছেন। এখন এর জন্য একটি দলিল করা হলো যার প্রমাণ হচ্ছে যে আপনি জিনিসটি কিনছেন। এখানে এই দলিলের ব্যাপারটির ডিজিটাল নাম হচ্ছে token আর এই দলিলের পরিবর্তে দলিলের কাজটি একটি Non-fungible token এর মাধ্যমে করা যেতে পারে। আর একেই বলে NFT বা Non-fungible token।
অর্থাৎ আপনি সহজ ভাষায় বলতে পারেন যে, একটি দলিলকে বা কোন একটি সম্পদকে Blockchain এর মধ্যে একটি token এর মাধ্যমে জমা রাখাকেই Non-fungible token বা NFT বলে।
NFT কিভাবে কাজ করে?
সাধারণত বাস্তব জগৎ-এর যেকোন কিছু tokenizing করে এটি NFT তে রূপান্তর করে বেচা-কেনা করা হয়। অর্থাৎ কোন একটি পণ্যর ডিজিটাল মালিকানা দলিল হচ্ছে NFT।
আর এই NFT ইথেরিয়াম ব্লকচেইন দ্বারা সুরক্ষিত। যার ফলে নতুন NFT মালিকের রেকর্ড পরিবর্তন করা সম্ভব না, এমনকি সেই NFT অনুলিপি করাও সম্ভব না।
NFT সহজেই ডিজিটাল অবজেক্ট থেকে তৈরি করা হয়, এতে বাস্তব এবং ডিজিটাল প্রোডাক্ট উভয় আইটেম অন্তর্ভুক্ত থাকে যার মধ্যে রয়েছে সঙ্গীত, টুইট, জিআইএফ(GIF), আর্ট, ডিজাইনার অবজেক্ট ইত্যাদি। আর যেহেতু NFT অনেক সিকিউর একটি মাধ্যম, তাই এর মাধ্যমে মূল্যবান জিনিসের মালিকানা নিশ্চিত করা এবং বিক্রি করার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
Ethereumবা ইথেরিয়াম কি?
Ethereum হচ্ছে একটি প্রযুক্তি বা ডিজিটাল অর্থ। অর্থাৎ আমরা যেমন টাকা বা ডলার ব্যবহার করে থাকি তেমটি হচ্ছে Ethereum, তবে একটি ডিজিটাল অর্থ। বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
যে কোনো সুরক্ষিত ডিজিটাল প্রযুক্তি তৈরি করতে যে কেউ ইথেরিয়াম ব্যবহার করতে পারে। এটিতে ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা একটি টোকেন রয়েছে। যার ফলে এটি অনেক সিকিউর।
Ethereum পরিমাপযোগ্য, প্রোগ্রামেবল, সুরক্ষিত এবং বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি ডেভেলপার এবং এন্টারপ্রাইজগুলির জন্য পছন্দের ব্লকচেইন যা এর উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তি তৈরি করছে। আর তেমনি একটি প্রযুক্তি হচ্ছে NFT যা Ethereum প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
NFT এর উদাহরণ
NFT কি সেটা তো বোঝালাম। কিন্তু NFT দিয়ে আমরা কি কি বেচা-কেনা করতে পারব? বা এইটা দিয়ে কিসের কিসের ডিজিটাল টোকেন তৈরি করা যাবে?
আপনি চাইলে যেকোন জিনিসের NFT তৈরি করতে পারবেন এবং সেটি বিক্রি করতে পারবেন। তবে আমি যেসব জিনিসে NFT বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর একটি লিস্ট তৈরি করে দিলাম।
- artwork
- music
- video
- GIF
- photography
- tweet
- memes
আসলে এক কথায় আপনি চাইলে যেকোন কিছু NFT এর সাহায্য বিক্রি করতে পারবেন।
NFT কিভাবে তৈরি করা যায়?
যে কেউ চাইলে NFT বানাতে পারবে। চলুন দেখে নেয়া যাক কিভাবে NFT বানাতে হয়।
১. পণ্য সিলেক্ট করুন
প্রথমে আপনাকে একটি পণ্য সিলেক্ট করতে হবে, যেটাকে আপনি NFT তে রূপান্তর করবেন। এটি একটি ছবি, গান, ভিডিও, টুইট বা অন্য যেকোন কিছু হতে পারে।
২. ব্লচেইন সিলেক্ট করুন
এখন আপনাকে আপনার ব্লকচেইন সিলেক্ট করতে হবে। সবচেয়ে পপুলার বা জনপ্রিয় NFT ব্লকচেইন হচ্ছে Ethereum। আপনি চাইলে অন্য ব্লকচেইনও ব্যবহার করতে পারেন। যেমন Tezos, Polkadot, Cosmos, এবং Binance Smart Chain।
৩. ডিজিটাল ওয়ালেট সেটআপ
আপনার যদি একটি ডিজিটাল ওয়ালেট না থাকে, তাহলে আপনাকে একটি ডিজিটাল ওয়ালেট সেটআপ করতে হবে। কারণ আপনার প্রাথমিক বিনিয়োগের জন্য কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রয়োজন হবে। ওয়ালেট আপনাকে আপনার ডিজিটাল সম্পদে এক্সেস প্রদান করবে। শীর্ষ NFT ওয়ালেটগুলির মধ্যে রয়েছে Metamask, Math Wallet, AlphaWallet, Trust Wallet, এবং Coinbase Wallet।
একবার আপনি আপনার ডিজিটাল ওয়ালেট সেটআপ করার পরে, আপনাকে কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে হবে। বেশিরভাগ NFT প্ল্যাটফর্ম Ethereum গ্রহণ করে, কেননা আমরা আগেই জেনেছি Ethereum ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত ক্রিপ্টোকারেন্সি।
আপনি যদি অন্য কোথাও কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিক হন, তাহলে আপনি এটিকে আপনার ডিজিটাল ওয়ালেটের সাথে সংযুক্ত করে ফেলতে পারেন, যার ফলে আপনি NFT তৈরি এবং বিক্রি করতে এটি ব্যবহার করতে পারেন।
৪. NFT মার্কেটপ্লেস সিলেক্ট করুন
এখন আপনার কাছে একটি ডিজিটাল ওয়ালেট এবং কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়ে গেলে, তাহলে এখন আপনার NFT তৈরি করা (এবং, আশা করি, বিক্রি) শুরু করার সময়। এর জন্য, আপনাকে একটি NFT মার্কেটপ্লেস বেছে নিতে হবে। শীর্ষস্থানীয় কিছু NFT মার্কেটপ্লেসের মধ্যে রয়েছে OpenSea, Axie Marketplace, Larva Labs/CryptoPunks, NBA, Rarible, SuperRare, Foundation, Nifty Gateway, Mintable এবং ThetaDrop।
৫. ফাইল আপলোড করুন
আপনি এখন শেষ পর্যন্ত আপনার NFT মিন্ট করতে প্রস্তুত। আপনার নির্বাচিত NFT মার্কেটপ্লেসে একটি নির্দেশক থাকার কথা। যেখানে আপনাকে দেখানো হবে আপনি কিভাবে আপনার ফাইল আপলোড করতে পারবেন। সেই প্রক্রিয়ায় আপনাকে আপনার ডিজিটাল ফাইল (একটি PNG, GIF, MP3, বা অন্য ফাইল যেকোন ফাইল) আপলোড করতে হবে। এবং এর মাধ্যমে আপনি সেই ফাইলটিকে একটি বিপণনযোগ্য NFT তে পরিণত করতে সক্ষম হবেন৷
৬. বিক্রির প্রক্রিয়া নির্ধারণ করুন
এখন সবকিছু করা শেষ। এখন বিক্রির প্রক্রিয়া সেটআপ করার সময় হয়েছে।
- নির্দিষ্ট একটি মূল্য বিক্রি: আপনার NFT এর জন্য একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করুন। সেই মূল্য প্রথম ব্যক্তি আপনার NFT টি ক্রয় করতে পারবে
- নিলামের সময় নির্দিষ্ট করুন: আপনি আপনার NFT কে নিলামে তুলতে পারেন এবং বিড করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে পারেন
- সীমাহীন নিলাম: আপনি চাইলে নিলামের সময় আনলিমিটেড করতে পারেন
NFT এর ভবিষ্যৎ
এইটুকু পড়বার পর হয়তোবা আপনি নিজেই NFT এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারছেন। নিঃসন্দেহে NFT আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে যাচ্ছে। এটি পুরো প্রযুক্তির দুনিয়াকে পরিবর্তন করে দিবে।
NFT এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে হাজার হাজার ডলার খরচ করেও NFT কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই। এইভাবে যদি চলতে থাকে, তবে NFT এর জনপ্রিয়তার জৌলুশ খুব শীঘ্রই কমবে না বলে ধারণা করা যায়।
বাংলাদেশেও এর সম্ভাবনা অনেক ভাল। এইটা ঠিক যে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিটি এখনও ভাল ভাবে আসে নাই। তবে এর মানে এই না যে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির কোন গুরুত্ব নেই। এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে অনেক নতুন শাখা তৈরি হচ্ছে এবং এর ফলে অনেক মানুষও দরকার যারা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারবে।
মেটাভার্সে NFT এর ব্যবহার
মনে করেন আপনার কাছে একটি ডিজিটাল আর্টের NFT আছে। আপনি চাইলে আপনার ভার্চুয়াল বাসার দেয়ালে সেই ডিজিটাল আর্টটি সাজাতে পারেন। তারপর আপনি যখন আপনার বন্ধদের আপনার ভার্চুয়াল বাসায় দাওয়াত দিবেন তখন তারা আপনার ভার্চুয়াল বাসায় এসে সেই ডিজিটাল আর্টটি বা NFT টি দেখতে পারবে।
এই জিনিসটি বাস্তবে হতে অনেকটা সময় বাকি আছে। কিন্তু, এই বলে যে এটি হবে না বা হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। মেটাভার্সের বিচরণ শুরু হয়ে গেছে। আর আজকে থেকে কয়েক বছর পর এটি হয়তোবা আমাদের কাছে ফেসবুকের মতই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে যাবে।
NFT নিয়ে কিছু মজার ফেক্ট
চলুন এই NFT নিয়ে কিছু মজার ফেক্ট জেনে নেওয়া যাক।
- প্রত্যকটি NFT অনন্য। অর্থাৎ একটি সাথে আরেকটির কোন মিল নেই
- NFT এর মাধ্যমে আর্টিস্টরা নতুন নতুন মানুষের কাছে তাদের চিত্রকলাকে তুলে ধরতে পারে
- Opensea তে আপনি বিনামূল্য Minting করতে পারবেন
- বেশিরভাগ NFT তে ইথেরিয়াম ব্যবহৃত হয়
- প্রত্যক বছর NFT মার্কেট ১৮,০০০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে
- সবচেয়ে দামি NFT এর মূল্য হচ্ছে ৯১.৮ মিলিয়ন ডলার বা ৯০০ কোটি টাকা
- প্রথম NFT 2014 সালে আবির্ভূত হয়েছিল
- সমস্ত NFT বিক্রয়ের ৫০ শতাংশয়ের বেশি NFT বিক্রি হয় ২০০ ডলারের কমে
- সবচেয়ে বেশি NFT গ্রহণকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশই এশিয়াতে অবস্থিত
- থাইল্যান্ডে, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি NFT এর মালিক
সবচেয়ে বেশি মূল্য বিক্রি হওয়া ৫টি NFT
চলুন দেখে নেয়া যাক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মূল্য বিক্রি হওয়া ৫টি NFT এবং তাদের বিক্রিত মূল্য।
১. Beeple, Everydays: The First 5000 Days
ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মূল্য বিক্রি হওয়া NFT হচ্ছে “Beeple, Everydays: The First 5000 Days” যার বিক্রিত মূল্য ছিল ৬৯.৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩৮৫২৫ ETH বা ৬৫০ কোটি টাকা।
২. Julian Assange and Pak, Clock
২০২২ সালের ফেব্রয়ারিতে বিক্রি হওয়া এই NFT এর মূল্য হচ্ছে ৫২.৭ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৯৫৩ ETH বা ৫০০ কোটি টাকা।
৩. Beeple, Human One
Christie’s 21st Century Evening Sale এ বিক্রি হওয়া এই NFT টির মূল্য ছিল ২৮.৯ মিলিয়ন ডলার বা ৪৭০০ ETH বা ২৭৫ কোটি টাকা।
৪. CryptoPunk #5822
দিপাক নামে একটি ব্যক্তি এই NFT টি কিনেছিলেন ২৩.৭ মিলিয়ন ডলারে বা ৮০০০ ETH এ বা ২২৫ কোটি টাকায়।
৫. CryptoPunk #7523
এই NFT টির আরেক নাম হচ্ছে “Covid Alien” যা বিক্রি হয়েছিল ১১.৭ মিলিয়ন ডলারে বা ৪৭০০ ETH এ বা ১১২ কোটি টাকায়।
শেষের কথা
তো এই ছিল NFT টি নিয়ে এক বিরাট আলোচনা। আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে আপনি NFT সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন।